সাজেদুল করিম:
কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী জন্মগ্রহণ করেন ২১ মে, ১৮৩৫ সালে কলকাতার নিমতলায়। পূর্বপুরুষেদের আদি নিবাস ফরাসডাঙ্গায়। পারিবারিক পদবি ‘চট্টোপাধ্যায়’। পিতা দীননাথ চক্রবর্তী। তিনি শৈশবে নিজ গৃহে সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন।
বিহারীলাল চক্রবর্তী আধুনিক গীতি কবিতার একজন স্রষ্টা। তাঁর মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে গীতি কবিতার সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসে গীতি কবিতা সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অতুলনীয়। বাংলা কবিতায় প্রথম তিনিই কবির অন্তর্জগতে সুর তোলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি বাংলা কবিতায় প্রচলিত ধারার পরিবর্তন করে গীতি কবিতার ধারাচালু করেন। সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কবিগণের প্রভাব থাকলেও নিজস্ব রীতিই ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায়। প্রকৃতি, প্রেম ও সংগীতের উপস্থিতি চমৎকারভাবে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত হয়েছে তাঁর কবিতায়। সরল ভাষা,তৎসম ও তদ্ভব শব্দের যুগপৎ ব্যবহার দেখা যায় তাঁর কবিতায়। কবির কবিতার বিষয়-ভাবনা, প্রকাশভঙ্গির প্রক্রিয়া , সূক্ষ্ম ভাব, সৌন্দর্য, , ছন্দ-অলঙ্কারের অভূতপূর্ব ব্যবহার কবি মানসকে মুগ্ধ করে তোলে। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা পূর্ণিমা, সাহিত্য-সংক্রন্তি, অবোধবন্ধু প্রভৃতি। বাংলা গীতি কবিতার উদ্ভাবক ও জনক বিহারীলাল চক্রবর্তী।বাংলা সাহিত্যের ‘ভোরের পাখি’ বলা হয় বিহারীলাল চক্রবর্তীকে‘।ভোরের পাখি’ উপাধি দেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বাধিক প্রভাবিত হয়েছেন – বিহারীলাল চক্রবর্তী দ্বারা।তাঁর ’তত্ত্বাশ্রয়ী কাব্য’ শ্রেণীর রচনা ‘সাধের’ আসন।
প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সংগীত শতক'(১৮৬০)।
শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ – ‘সারদামঙ্গল’। প্রথম স্বার্থক গীতিকাব্য – ‘বঙ্গসুন্দরী’।’বন্ধুবিয়োগ’ ও ‘প্রেম প্রবাহিণী কাব্যে উপজীব্য নিজের ও বন্ধুদের জীবনের সাধারণ ঘটনা। বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০) কাব্যে তিনি নারীকে দেখেছেন ’মাতা-জায়া-কন্যাসহ বিচিত্র রূপে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সারদামঙ্গল’ কাব্য (১৮৭৯) সম্পর্কে লিখেছেন – “সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমন্ডিত মেঘমালার মত সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধ রূপের আভাস দেয়। কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না। অথচ সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে আকটি অপূর্ণ পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।”
তিনি নিসর্গসন্দর্শন’ কাব্যগ্রন্থে বঙ্গপ্রকৃতির শোভা অপূর্ব ভাব-ভাষা বর্ণনা করেছেন।
কবির উল্লেখযোগ্য রচনাবলির মধ্যে রয়েছে- ‘স্বপ্নদর্শন’(১৮৭০), ’প্রেমপ্রবাহিণী’ (১৮৭০), ‘নিসর্গসন্দর্শন’ (১৮৭০) ‘কবিতা ও সংগীত, (১৮৭০),‘নিসর্গসঙ্গীত’ (১৮৮১),‘মায়াদেবী’ (১৮৮২), ‘বাউলবিংশতি’ (১৮৮৭),’গোধূলি’ (১৮৯৯) প্রভৃতি। ৫৯ বছর বয়সে গীতিকবি ২৪ মে, ১৮৯৪ সালে কলকাতায় পরলোক গমন করেন।