20.9 C
Rangpur City
Sunday, December 22, 2024
Google search engine
Homeসাহিত্যচর্যাপদ এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস

চর্যাপদ এবং বাংলা ভাষার ইতিহাস

লেখক সাজেদুল করিম

বাংলা ও বাংলাদেশ

ভাষা নদীর স্রোতের মতো স্বতঃ প্রবাহিণী।কিন্তু নিয়তই সে গতিপথ পরিবর্তন করে চলে। ভাষার এই পরিবর্তন মূলত ধ্বনিরই পরিবর্তন।ভাষার জন্ম ও বিকাশ হয়েছে মানুষের সামাজিক বোধ অন্তর প্রেরণা থেকে। মানুষের মনের বাইরে ভাষার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।সুতরাং মানুষের মনের খেয়াল অনুযায়ী নিয়মানুবর্তিতার ব্যতিক্রম হতে পারে এবং হয়েও থাকে। ভাষাতত্ত্ব এসব ব্যতিক্রম এর অনুসন্ধান ও তার কারণ নির্দেশ করে। বাংলা ভাষার মতো দ্রুত পরিবর্তনশীল ভাষার আলোচনায় বর্ণনামূলক পদ্ধতি অপরিহার্য।ভাষার মূল কাঠামো হলো রূপ, বাক্যরীতি ও ধ্বনি রীতি। বর্ণনামূলক পদ্ধতি ধ্বনির উচ্চারণ, প্রগতি, সাদৃশ্য ও শব্দার্থ সহযোগে কোন ভাষার বর্তমান রূপের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ এর সহায়তা করে।এই কারণেই বাংলা ভাষার ধ্বনি রূপ, বাক্য গঠন ও ভাষার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দানে বর্ণনামূলক পদ্ধতি সবচেয়ে বেশি সহায়ক।  

অন্য সকল কিছুর মত ভাষা ও জন্ম নেয়, বিকশিত হয় এবং ক্রমে ক্রমে রূপ বদলায়। আজ বাংলা ভাষায় আমরা কথা বলি, কবিতা লিখি ও গান গাই। অনেক আগে এ ভাষা এরকম ছিল না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ আমরা অনেকে গ্রন্থটি পড়তেও পারবো না ওর অর্থও বুঝবো না। কারণ হাজার বছর আগে যখন বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল তখন তার ছিল আধো গঠিত এবং ব্যবহৃত শব্দ গুলো আর কেউ ব্যবহার করে না ও ভাষার বানানো আজকের মত নয়। চর্যাপদে যে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয় তা একদিনে হয়নি বাংলা ভাষা একটি পুরনো ভাষার ক্রমবদলের ফল যার নাম প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা। এই ভাষাটি মানুষের মুখে মুখে বদলে পরিণত হয়েছে বাংলা ভাষায়। সব মানুষ এক রকম উচ্চারণ করে না কঠিন শব্দ মানুষ সহজ করে উচ্চারণ করতে চায় তাই ওই ভাষার অনেক শব্দের উচ্চারণ ও বানান বদলে গেছে। দেখা যায় কোন ভাষায় একশ বছর আগে যেসব শব্দ ব্যবহৃত হতো  সেগুলোর আর ব্যবহার হচ্ছে না সেগুলোর বদলে  মহাসমারোহে  জায়গা করে নিয়েছে নতুন নতুন নতুন শব্দ। এভাবে ভাষা বদলে যায় এক ভাষার বুক থেকে জন্ম নেয় নতুন এক ভাষা। যেমন কিছু  শব্দের পরিবর্তন দেখা যায়। চন্দ্র একটি প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃত শব্দ তার উচ্চারণ করতে বেশ কষ্ট হয়।ক্রমে ক্রমে মানুষ এর উচ্চারণ করতে লাগল চন্দ। র-ফলা বাদ গেল, উচ্চারণ সহজ হয়ে উঠল এরকম চললো অনেক বছর। পরে নাসিক্য ধ্বনি দন্ত ‘ন’ বাদ গেল ‘চ’ এর গায়ে লাগল অনুনাসিক আ-কার । চন্দ্র হয়ে উঠলো চাঁদ। কর্ণ হয়ে উঠল কণ্ন। তার পরে হয়ে উঠল কান। এরকম করে শব্দের পরিবর্তন হয়ে যায় ও ভাষা বদলে যায় ।  প্রাচীন আর্য ভাষা দিনে দিনে বদলে এক সময় হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা। ভাষা বদলের কিন্তু নিয়ম রয়েছে খামখেয়ালে ভাষা বদলায় না, ভাষা মেনে চলে কতগুলো নিয়ম- কানুন। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা একদিন পরিবর্তন হয়ে  রূপ নেয় পালি নামক এক ভাষায়।  পালি ভাষায় বৌদ্ধরা তাদের ধর্মগ্রন্থ ও অন্যান্য নানা রকমের বই লিখেছে।  পালি ভাষা  ক্রমে আরো পরিবর্তন হয়, তার উচ্চারণ আরও সহজ সরল রূপ নেয় এবং জন্ম নেয় প্রকৃত ভাষা। এ বদল একদিন হয়নি প্রায় হাজার বছরেরও বেশী সময় লেগেছে এর জন্য প্রাকৃত ভাষা আবার বদলাতে থাকে অনেক দিন ধরে । তারপর দশম শতকের মধ্য ভাগে এসে এ প্রাকৃত ভাষার আরো বদলানো একটি রূপ থেকে উদ্ভূত হয় একটি নতুন ভাষা, যার নাম বাংলা। এ ভাষা আমাদের। কেউ কেউ মনে করেন বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে সপ্তম শতাব্দীতে কিন্তু আজকাল আর বাংলা ভাষাকে এত প্রাচীন বলে মনে করা হয় না। মনে করা হয় ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোন সময় বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল। প্রাচীন বাংলা ভাষার পরিচয় আছে ‘চর্যাপদ’ নামক এই বইটির কবিতাগুলোতে। এর বাঙলা ভাষার অর্থাৎ প্রাচীন বাংলা ভাষার জন্মলাভ করেছে তার আকৃতি পরিপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।এর ভাষা কেমন কেমন লাগে, এর শব্দগুলো আমাদের অপরিচিত এর শব্দ ব্যবহারের রীতি আজকের রীতি থেকে ভিন্ন। এর কবিতা গুলো পড়ে অর্থ বুঝতে কষ্ট হয়। আলো-অন্ধকারের রহস্য এর ভাষার মধ্যে জড়িয়ে আছে এজন্য এর ভাষাকে বলা হয় সন্ধ্যাভাষা।  জন্মের পর থেকে বাংলা ভাষা পাথরের মত একই স্থানে বসে থাকেনি।বাংলা ভাষা পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের কণ্ঠে কবিদের রচনায়। এ বদলের প্রকৃতি অনুসারে বাংলা ভাষাকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হয়।প্রথম স্তরটি প্রাচীন বাংলা ভাষা। এর প্রচলন ছিল ৯৫০থেকে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তারপর দেড়শ বছর ১২০১থেকে ১৩৫০খ্রিস্টাব্দপর্যন্ত বাংলা ভাষার কোন নমুনা পাওয়া যায়নি।দ্বিতীয় স্তরটি মধ্যযুগের বাংলা ভাষা।১৩৫০থেকে১৮০০খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে ভাষা আমরা পাই তাই মধ্যযুগের বাংলা ভাষা  এ ভাষাও আজকের বাংলা ভাষার মতো নয়। তবে তা হয়ে উঠেছে আমাদের ভাষার অনেক কাছাকাছি। এ ভাষায় লেখা সাহিত্য অনায়াসে পড়া যায় বোঝা যায় ।১৮০১খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয়। আধুনিক বাংলা ভাষা। আধুনিক বাংলা ভাষাকেও ইচ্ছা করলে কয়েকটি ভাগে ভাগ করতে পারি। আজ যে দেশের নাম বাংলাদেশ তার আকৃতি কিন্তু চিরকাল এরকম ছিল না। আগে বাংলাদেশ বিভক্ত ছিল নানা খন্ডে, তার নামও ছিল নানা রকম। কিন্তু বাংলা বা বঙ্গ অথবা বাঙালা যে নামেই ডাকি না কেন এর নামটি এসেছে কোথা থেকে?এদেশের নামের কাহিনী বলেছেন সম্রাট আকবরের সভা কবি এক রত্ন আবুল ফজল। তিনি বলেছেন, বঙ্গ শব্দের সাথে আল শব্দটি মিলিত হয়ে দেশের নাম হয়েছে  বাঙ্গাল বা বাঙ্গালা। আমরা আজ বলি বাঙলা। আল্ কাকে বলে? এদেশে আছে ক্ষেতের পর ক্ষেত এক ক্ষেতের সাথে অপর ক্ষেত মিলে না যায় তার জন্য থাকে আল। আল বলতে বাঁধও বোঝায়।এদেশ বৃষ্টির দেশ, বর্ষার দেশ তাই এখানে দরকার হতো অসংখ্য বাঁধের। আল বা বাঁধ বেশি ছিল বলেই এদেশের নাম হয়েছে বাঙ্গালা বা বাঙলা। বাংলা নামের ব্যুৎপত্তিটি একটু অন্যরকম। বাংলাদেশ বহু বছর আগে বিভক্ত ছিল নানা জনপদ বা অংশে। একেকটি কোমের নর-নারী নিয়ে গড়ে উঠেছিল এক একটি জনপদ। ওই জনপদের নাম হতো যে কোম সেখানে বাস করতো তার নামে। কয়েকটি কোম এর নাম : বঙ্গ, গৌড়, পুন্ড্র, রাঢ়।এ কোমগুলো যে জনপদগুলোতে বাস করতো পরে সে জনপদ গুলোর নাম হয় বঙ্গ, গৌড়, পুন্ড্র ও রাঢ়।এগুলো ছিল পৃথক রাষ্ট্র।প্রাচীনকাল থেকে ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিল এসব ভিন্ন ভিন্ন জনপদে বিভক্ত। একটি রাষ্ট্রে জমাট বাঁধতে এর অনেক সময় লেগেছে। সপ্তম শতাব্দীর আদি ভাগে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজা হন। তাঁর সময়ে বর্তমানে পশ্চিম বাংলা প্রথমবারের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়।তারপর বাংলাদেশের তিনটি জনপদ বড় হয়ে দেখা দেয়। অন্যান্য জনপদ সেগুলোর কাছে ম্লান হয়ে যায়। এ জনপদ তিনটি হচ্ছে পুন্ড্র, গৌড়, রাঢ়।শশাঙ্ক, পাল রাজারা অধিপতি ছিলেন রাঢ়ের অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের। কিন্তু তাদের সময় একটি মজার কাণ্ড ঘটে। তারা নিজেদের রাঢ়াধিপতি বলে পরিচয় না দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিতে থাকেন গৌড়াধিপতি  বলে। গৌড় নামে সমগ্র দেশকে সংঘাত করতে চেয়ে ছিলেন শশাঙ্ক, পাল রাজারা এবং সেনরাজারা। কিন্তু তাদের চেষ্টা সার্থক হয়নি। কেননা গৌড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল বঙ্গ। পাঠান শাসনকালে জয় হয় বঙ্গের।পাঠান শাসকেরা বঙ্গ নামে একত্র করেন বাংলার সমস্ত জনপদ। ইংরেজদের শাসন কালে বাংলা নামটি আরো প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু আকারে হয়ে পড়ে ছোট।  ১৯৪৭ সালে ভারত বর্ষ ত্রিখন্ডিত হয়।বাংলার একটি বড় অংশ হয়ে পড়ে পাকিস্তানের উপনিবেশ তখন তার নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান কিন্তু বাঙালিরা বাংলার এনাম মনেপ্রাণে কখনো গ্রহণ করেনি। বাংলা সাহিত্য, বাংলাদেশ এবং বর্তমানে যাকে পশ্চিমবাংলা বলা হয় তার মিলিত সম্পদ। 

সহায়ক গ্রন্থঃলাল নীল দীপাবলি ও ভাষা সন্দর্শন।

News
Newshttps://sotterkontho24.com/
রোড নংঃ ৫/১, বাসা নংঃ ৩৮৮, হোল্ডিং নংঃ ৪৪৫ স্টেশন রোড, আলমনগর, পীরপুর, রংপুর। মোবাইলঃ ০১৭৩৬৫৮৫৭৭৭
RELATED ARTICLES
- Advertisment -
Google search engine

জনপ্রিয় নিউজ

সাম্প্রতিক মন্তব্য