সাজেদুল করিম
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে অন্যতম কবি হলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য | তিনি তাঁর জীবনকালে যা কিছু সাহিত্যসৃষ্টি করে গেছেন তা সত্যিই অনবদ্য তিনি মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদ আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে সেই সময় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন | তাঁর সমস্ত সাহিত্য কর্ম আজও প্রত্যেক বাঙালি পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্ম – ১৫ই আগস্ট, ১৯২৬ কোলকাতার কালীঘাট অঞ্চলের অন্তর্গত ৪৩নং মহিম হালদার স্ট্রিটে মামার বাড়িতে | তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ফরিদপুর জেলার উনশিয়া গ্রামে | সুকান্তের বাবার নাম নিবারণ ভট্টাচার্য। তাঁর বাবা গ্রন্থাগারের মালিক ছিলেন । মায়ের নাম সুনীতি দেবী, (গৃহিণী)।
পরিবারে ছয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় | তিনি তাঁর বড় দাদা মনমোহন এবং বৌদি সর্জু দেবীর বড় আদরের ছিলেন | তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ ছিলেন রানীদি | সেইসময়ের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক মনিন্দ্রলাল বসুর “সুকান্ত” গল্পটি পড়ে, তিনি তাঁর নাম রেখেছিলেন সুকান্ত |
তাঁর প্রিয় রানীদির জন্যই তিনি সাহিত্যকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন | দুর্ভাগ্যবশত তাঁর রানীদি তাঁর কোনো সাহিত্যকর্মই দেখে যেতে পারেননি, তাঁর দিদির মৃত্যুর কিছুদিন পরেই মা সুনীতি দেবীও মৃত্যু বরণ করেন |
পরপর চোখের সামনে দুটো মৃত্যু, কবিকে ভীষণ শোকাহত এবং মর্মাহত করেছিল। তাঁর মানসিক অবস্থা বিধ্বস্ত হয়।এই সময় তিনি রচনা করেন বহু কবিতা | সে সময় সেইসব কবিতাই ছিলো তাঁর একমাত্র সঙ্গী |
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কলকাতার কমলা বিদ্যামন্দির থেকে | তাঁর লেখা প্রথম লেখা ছোটগল্প প্রকাশিত হয় বিদ্যালয়ের পত্রিকা “সঞ্চয়ে” | তারপর তিনি ভর্তি হন বেলেঘাটা দেশবন্ধু হাইস্কুলে | ১৯৪৫ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন ও দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি অকৃতকার্য হন |
স্কুল জীবন থেকেই কবি সুকান্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন | এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কাজের সাথে জড়িত থাকার জন্য, তাঁর পড়ার লেখার পরিসমাপ্তি ঘটে । ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অনৈতিক ব্রিটিশ শাসন প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন |
১৯৪১ সালে সুকান্ত ভট্টাচার্য কলকাতা রেডিও আয়োজিত “গল্পদাদুর আসর” নামক এক অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করতেন | যখন রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হয়, তখন সেই আসরেই তিনি নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
১৯৪৪ সালে তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন | সে বছরই “আকাল” নামক একটি সংকলন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন এবং শোষিত মানুষের জীবন, ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম, সমাজের দুর্দশা ও শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কবিতা লেখেন |
মাত্র এগারো বছর বয়সে তিনি “রাখাল ছেলে” নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। পরে “হরতাল” নামক গ্রন্থে সংকলিত হয় |
তাঁর রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- ছাড়পত্র (১৯৪৭), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), ইত্যাদি। পরবর্তী সময়ে উভয় বাংলা থেকেই “সুকান্ত সমগ্র” নামে তাঁর রচনাবলী প্রকাশিত হয় ।
অত্যধিক পরিশ্রম করার ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথমে ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন | এবং ১৩ই মে, ১৯৪৭ সালে কলকাতার ১১৯ নম্বর লাউডট স্ট্রিটের অন্তর্গত “রেড এড কিওর হোমে” মাত্র ২১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন |